রুকইয়া কি ও কেন ? রুকইয়া করার নিয়ম
সুপ্রিয় পাঠক । আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ । সকলের সুস্থতা এবং সুদীর্ঘ নেক হায়াত কামনা করে শুরু করছি আজকের আলোচনা । আজকের নির্ধারিত বিষয় রুকইয়া কি ও কেন ? রুকইয়া করার নিয়ম । এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পয়েন্টগুলো উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ। নিজে জানার জন্য, আমল করার জন্য এবং অন্যকে পৌঁছানোর নিয়তে পড়া শুরু করুন।
রুকইয়া অর্থ কি ?
রুকইয়া একটি আরবী শব্দ। শব্দটির অর্থ হলো ঝাড়ফুঁক, মন্ত্র ,সম্মোহন, যাদু ,তাবিজ ,কবজ ইত্যাদি ।
ব্যবহারিক অর্থে রুকইয়াহ শব্দটি সাধারণত ঝাড়ফুঁক বোঝানো হয় ।
রুকইয়া কাকে বলা হয় ?
পরিভাষায় রুকইয়া বলা হয় পবিত্র কুরআনের আয়াত, আল্লাহর বিভিন্ন জিকির, হাদীসে বর্ণিত দোয়া-দরুদ, কিংবা পূর্ব সূরী হক্কানী আলেম ওলামাগণের শেখানো পদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কোন বিপদ থেকে মুক্তি চাওয়া কিংবা রোগ থেকে আরোগ্য কামনা করা ।
কেন রুকইয়া করবেন ?
শারীরিক মানসিক এবং আত্মিক রোগের জন্য রুকইয়াহ করা হয় ।চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে সেই রোগের চিকিৎসা থাকুক কিংবা না থাকুক সর্বাবস্থায় যে কোন রোগের জন্য রুকইয়া করা হয় । রুকইয়া মনের আশা পূরণের জন্য কোন যাদু মন্ত্র নয় । নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হওয়ার জন্য কিংবা দ্রুত বিয়ে হওয়ার জন্য এটা কোন তদবিরনামা নয় ।
রুকইয়া পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা বা ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি করার অজিফাও নয় । বরং এটা একটা চিকিৎসা পদ্ধতি । মাত্র যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা করা হয় । আর চিকিৎসা মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রধান একটি চাহিদা । এই চিকিৎসার জন্যই মূলত আপনারা রুকইয়া করবেন ।
রুকইয়ার প্রয়োজনীয়তা:
আপনাদের কারো কারো মনে প্রশ্ন উঠতে পারে এই রুকইয়া নিয়ে এত আলোচনার কি দরকার ? এত লম্বা সময় ,পরিশ্রম ও মেধা ব্যয় করার কি উদ্দেশ্য ?এতে লাভ – ক্ষতিটাই বা কি ?
উত্তরে বলবো আপনারা কি আল্লাহর কালিমাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করতে চান ? সমাজ থেকে কুফুরী যাদু-ফিতনা নির্মূল করতে চান? কবিরাজ নামের শয়তান জাদুকরদের থেকে উম্মতকে দূরে রাখতে চান? তাহলে অবশ্যই আপনাদের প্রায় ভুলে যাওয়া রুকইয়ার সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করতে হবে । আর অবশ্যই এসব করার মাধ্যমে অর্জিত হবে মহান রবের সন্তুষ্টি ।
এখানে ইমাম ইবনুল কাইয়ুম রহ:এর কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তিনি বলেন, আল কুরআন হচ্ছে পরিপূর্ণ চিকিৎসা । মানসিক কিংবা শারীরিক । দুনিয়ার কিংবা আখিরাতের যাবতীয় রোগব্যাধির জন্য কোরআনের রয়েছে পরিপূর্ণ আরোগ্য । তবে এ থেকে নেয়ামত লাভের তাওফিক সবাইকে দেওয়া হয় না । সবাই এর উপযুক্ত নয় । রোগী সততা, আস্থা ,পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা, অকাট্য বিশ্বাস এবং চিকিৎসা যাবতীয় শর্ত পূরণের মাধ্যমে যদি এই কুরআনকে কেউ তার রোগের উপর উত্তম ভাবে প্রয়োগ করে ,তাহলে কোন ব্যাধি এর মোকাবেলা করতে পারবেনা । কিভাবে রোগব্যাধি আসমান জমিনের মালিকের ওই কথার মোকাবেলা করবে ? যা তিনি পাহাড়ের ওপর নাজিল করলে তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলত ,ভূমির ওপর নাযিল করলে ভূমিকে বিদূর্ণ করে দিত ।
সুতরাং শরীর ও মনের এমন কোন রোগ নেই যার চিকিৎসা আল-কোরআনে নেই । উপরন্তু এর প্রতিকার এবং তা থেকে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে । যাকে আল্লাহ তাআলা তার কিতাবের বুঝ দান করেছেন সেই কেবল এ থেকে সার্বিক সুস্থতা লাভ করে ধন্য হয় । কোরআন যাকে নিরাময় করবে না, আল্লাহ তাআলা ওতাকে নিরাময় করবেন না । কোরআন যাকে নিরাময় করবেন, আল্লাহ তাআলা ও তাকে নিরাময় করবেন ।
নিজে করুন নিজের রুকইয়া :
সেলফ রুকইয়া (নিজে নিজের রুকইয়া করা )অর্থাৎ নিজের জন্য বা নিজের পরিবারের জন্য নিজেই রুকইয়া করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম । যেকোনো সমস্যার শুরুর আগে যদি এর সমাধান জানা থাকে তাহলে এটা বেশিদূর পর্যন্ত গড়ায় না । যেমন কয়েক যুগ আগেও শুধু ডায়রিয়া হলে কত মানুষ মারা গেছে । গ্রামের পর গ্রাম খালি হয়েছে । কিন্তু এখন এখন সবাই জানে ডায়রিয়া হলে লবণ পানি শরবত খেলেই যথেষ্ট উপকার পাওয়া যায় । এবং উপকার ও হচ্ছে।
একইভাবে কেউ যদি জানে তার স্ত্রীকে কেউ যাদু- টোনা করেছে তখন তার কি করা উচিত ! নিজের বাচ্চার উপর কারো বদ নজর লেগেছে অথবা নিজের শরীরের কোথাও কোথাও ব্যথা হলে কি করা উচিত ! তাহলে পরিবারের সাধারণ সমস্যা গুলো ঝগড়া কিংবা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াবে না । বাচ্চাকে হয়তো কোন ওষুধ পত্র খাওয়ানো লাগবে না । নিজেই নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে পারবে । পর্দার বিধান ও লংঘন হবে না।
আর নিজে নিজের জন্য রুকইয়া করাতে ভয়ের কিছু নেই । এর কারণ হচ্ছে রুকইয়া করলে ও ডাক্তারের চিকিৎসা নেওয়া যায় । বরং প্রয়োজন মোতাবেক ওষুধ এবং রুকইয়া দুটোই গ্রহণ করা সুন্নাত ।
পড়ুন – নোটিশ লেখার নিয়ম
তাছাড়া কোরআনে ক্ষতিকর কিছু নেই । মূলত কোরআন শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক রোগের প্রতিষেধক । আমাদের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেখা যাওয়া জীবন্ত মুজিজা । আপনাদের হাতের কাছে থাকতেও কেন আপনারা তার যথাযথ ব্যবহার করবেন না ? আর এসব রুকইয়া করার জন্য আপনাদের সম্পূর্ণ কোরআন মুখস্ত করার কোন প্রয়োজন নেই । আপনারা দেখে দেখে তেলাওয়াত করতে পারবেন । অথবা শুধু সুরা ফাতেহা, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস ইত্যাদি দ্বারাও রুকাইয়া করতে পারবেন । আর আপনাদের তেলাওয়াত বিশ্ব বিখ্যাত কারীদের মত হওয়ারও দরকার নেই । আপনাদের যতদূর সম্ভব হয় শুদ্ধ করে পড়বেন। আর একদম শুদ্ধ না হলে ধীরে ধীরে শিখে নেবেন । আর কোরআন শেখা তো এমনই সবার ওপর আবশ্যক ।
নিজে নিজের রুকইয়া করা প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ধরে নেওয়া যায় । যেমনটা সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে অনেকেই করে থাকে । কোন সমস্যা হলে প্রথমে ফার্মেসি থেকে বা ঘরের ওষুধের বাক্স থেকে একটা ওষুধ খেয়ে নেয় । এরপর প্রয়োজন হলে এলাকার ডাক্তার বা অন্য কারো পরামর্শ নেয় ।এরপরও যখন ভালো না হয় তখন বড় ডাক্তার দেখায় । তদ্রূপভাবে প্রথমেই এখানে উল্লিখিত নিয়মগুলো ট্রাই করে দেখুন। এরপরেও কাজ না হলে বিজ্ঞ কারো দ্বারা রুকইয়া করান ।
কেন অন্যের জন্য রুকইয়া করবেন ?
আপনারা কেউ যদি আলেম হয়ে থাকেন কিংবা ধর্মীয় বিষয়ে মোটামুটি জানাশোনা ব্যক্তি, তাহলে আপনাদের কাজ হল অন্যদের রুকইয়া করা । অন্যদের এটা করতে উৎসাহিত করা । যদি আপনারা ফিকাহ, , আকাইদ, ইসলাহ- তাজকিয়া, তাবলীগ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সবার ব্যয় করবেন আর রুকইয়া এর বিষয়গুলো গ্রামে গঞ্জের ছোটখাটো আলেমদের হাতে ছেড়ে দিবেন তাহলে এটি ভুল সিদ্ধান্ত। কেননা আমাদের সমাজে , বদনজর ,জীন ইত্যাদি সমস্যাগুলো মানুষের মাঝে যতটা ব্যাপক এর সমাধানের ব্যাপারে মানুষ ততটাই অজ্ঞ । এ সকল সমস্যায় মানুষ যে পরিমাণ আক্রান্ত বিষয়টা তার চেয়ে বহু গুণে বেশি অবহেলিত । আর শরয়ী সমাধানের সাথে আমাদের দেশে ৯৯% মানুষই পরিচিত নয় ।
বরং বাস্তবতা হলো অধিকাংশ মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস হচ্ছে কুফরি কাটতে কুফরি করা লাগবে ( নাউজুবিল্লাহ) এজন্য তারা কবিরাজ, বৌদ্ধদের কাছে যায় । টাকা পয়সা হারায় । এভাবে ঈমান আমল নষ্ট করে । দুনিয়া এবং আখেরাতের পুঁজি হারিয়ে ফেলে । তাই এক্ষেত্রে যদি আলেম-ওলামাগণ এগিয়ে আসেন কিংবা সচেতন ধার্মিক ব্যক্তি এগিয়ে আসেন তাহলে সমাজের লোকেরা উপকৃত হবে । পাশাপাশি সমাজ থেকে কুফর, শিরক ইত্যাদি দূর করতে বড় ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে ।
অন্যের রুকইয়া করার উপকার :
অন্য মানুষদের রুকইয়া করলে বেশ কিছু ফায়দা অর্জিত হয় ।
যেমন-
১. দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ
২. ঈমান-আমল বৃদ্ধি পায়
৩. পরের বিপদে সাহায্য সহযোগিতা করা
৪. কুফরের বিরুদ্ধে তাওহীদের পক্ষে সংগ্রাম করা
৫. তাওয়াক্কুলের শিক্ষা ।
এবার উল্লিখিত পাঁচটির বিষয়ে সংক্ষেপে আর একটু করে জেনে নিন।
১. দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ
যিনি অন্যদের রুকইয়া করেন তাকে রাক্কী বলা হয় । একজন রাক্কী মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার চমৎকার সুযোগ পেয়ে যান । যা রুকইয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ । আর জীন, জাদু ইত্যাদি সমস্যাগুলো নিয়ে যারা আসে তাদের অনেকেই থাকে এমন যারা ধর্ম- কর্ম পালনের ব্যাপারে উদাসীন । রুকইয়া করার সময় তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর সুযোগ পাওয়া যায় ।
আর এদের বিরাট একটা অংশ এমন যারা সুস্থতা লাভের আশায় কবিরাজ, বৌদ্ধদের কাছে ঘুরে ঘুরে ইতিমধ্যে কুফরি ,শিরকী কাজে কর্মে লিপ্ত থেকেছে । ফলে এ মোক্ষম সুযোগে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে সকল কুফুরের থাবা থেকে রক্ষা করা এবং তাদের কাছে তাওহীদের বার্তা পৌঁছানো যায় ।
২. ঈমান-আমল বৃদ্ধি পায়
যিনি রুকইয়া করেন তাকে প্রতিদিন দীর্ঘক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করতে হয় ।এতে কোরআনের সাথে তার সম্পর্ক দিন দিন বাড়ে । পাশাপাশি আরো বিভিন্ন আমল করতে হয় । এই আমল গুলোর বদৌলতে ঈমান মজবুত হয় । আমলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং দেহ মনে নূর বিরাজ করে। এতে অন্যরা যেমন উপকৃত হয় আবার ফজিলতের কাজ বারবার সম্পাদন করায় অনেক সওয়াব আমলনামায় জমা হয় ।
৩.পরের বিপদে সাহায্য সহযোগিতা করা
কোন মুসলমান যদি রোগে আক্রান্ত হয় আর তার সেই রোগ/ বিপদে সাহায্য করার জন্য রুকইয়া করা হয় তাহলে তো অনেক সওয়াব পাওয়া যাবে । হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোন মুমিনের যেকোনো বিপদ দূর করে দিবে আল্লাহ তা’আলা কেয়ামতের দিন তার বিপদ দূর করবেন । ( সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৮৬৭) এ সম্পর্কে আরও অনেক হাদীস আছে । প্রয়োজন হলে দেখে নিতে পারেন । ( অথবা কমেন্ট করুন। লিখে দেওয়া হবে )
৪. কুফরের বিরুদ্ধে তাওহীদের পক্ষে সংগ্রাম
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ: এজন্য মুখলিস রাক্কীদের ব্যাপারে বলেছেন ,
রাক্কীর উচিত গোনা থেকে দূরে থাকা । যেন এই সুযোগে জ্বীন তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে । সে তো আল্লাহর পথে একজন জিহাদকারী ব্যক্তি । আর রুকইয়া চর্চা করাও প্রচেষ্টার একটি উত্তম পদ্ধতি । তাই যতদূর পারা যায় সতর্ক থাকা উচিত যেন তার পাপ তার শত্রুকে বিজয়ী হতে সহায়তা না করে ।
রুকইয়া করার বিষয়টি যদিও প্রকৃত প্রচেষ্টার মত নয় তবুও তিনি এখানে কুফর শিরকের বিরুদ্ধে রুকইয়া লড়াইয়ের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন।
৫. তাওয়াক্কুলের শিক্ষা
একজন রাক্কী মহান আল্লাহর অনুগ্রহের জটিল কঠিন সমস্যার সমাধান দেন । শক্তিশালী শয়তানদের শায়েস্তা করেন । ভয়ংকর সব টোনা নষ্ট করেন । আর এতসব অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে শুধু আল্লাহর উপর ভরসা করে লড়াই চালিয়ে যান । একের পর এক নুসরত প্রত্যক্ষ করে মুখলিস রাক্কীর ঈমান এক অনন্য স্তরে পৌঁছে যায় । মূল কথা এটা এমন একটা মেহনত যেখানে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ব্যতীত কোন দুনিয়াবী সাহায্যে উপকারে আসে না । এভাবেই একজন রাক্কী তায়াওকুল্লে পূর্ণতা লাভ করে ।
রুকইয়া করার নিয়ম
রুকইয়া করার শর্ত :
রুকইয়া এর পদ্ধতিতে চিকিৎসা করার জন্য শরীয়তের নির্ধারিত অতিক্রম না করলে এটা জায়েজ আছে । এ ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেছেন ,রুকইয়াতে যদি শিরক না থাকে তাহলে কোন সমস্যা নেই। ( সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৫৪৪)
রুকইয়া বৈধ হওয়ার জন্য আলেমদের অভিমত হলো এটা তো অবশ্যই শিরক এবং কুফর থেকে মুক্ত হতে হবে। এমনকি এসবের সন্দেহ ও থাকা যাবে না । এ জন্য ওলামা কেরাম কয়েকটি শর্তের ব্যাপারে একমত হয়েছেন –
১. কোন শিরক- কুফর অথবা হারাম বাক্য থাকা যাবে না।
২. যা দ্বারা রুকইয়া করা হবে সেটা স্পষ্ট বাক্যে হতে হবে। তার অর্থ ভালভাবে বুঝা যায়।
৩. দুর্বোধ্য কোন সংকেত বা ভাষায় হওয়া যাবে না । যার অর্থ স্বাভাবিকভাবে মানুষ বোঝে না ।
রাক্কীর বিশেষ তিনটি আমল :
অন্যের উপকার করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে । বিশেষ করে জ্বীন সংক্রান্ত তদবীর কারী ব্যক্তির স্ত্রী, সন্তানের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল । এক্ষেত্রে ভয়ের কিছু নেই। নিজের শরীর বন্ধ করে রাখতে হবে। অন্য আমলের পাশাপাশি নিয়মিত তিনটি আমল করে যেতে হবে ।
শরীর বন্ধ করার আমল
প্রথম আমল :
প্রফেশনাল তদবীর কারী ব্যক্তি দৈনিক ফজর ও মাগরিবের সময় আয়াতুল কুরসি ও চারকুল অর্থাৎ সূরা কাফিরুন , সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস তিনবার করে পাঠ করে নিজ শরীরে ফুঁক দিবেন।
দ্বিতীয় আমল :
তদবীর কারী ব্যাক্তি সর্বপ্রকার অনিষ্ট থেকে বাঁচতে এই দুআটি দৈনিক ফজর ও মাগরিবের সময় পড়া কখনো ভুলবেন না।
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلاَ فِي السّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ .
অনুবাদ: আমি আল্লাহ পাকের নামের উসিলায় সাহায্য প্রার্থনা করছি ৷ যার নাম সঙ্গে থাকা অবস্থায় আসমান জমিনের কোনকিছুই ক্ষতিসাধন করতে পারে না ৷ এবং তিনি সর্বশ্রোতা ,সর্বজ্ঞাতা, সবকিছু শোনেন ,সবকিছু জানেন ৷
ফজিলত: হযরত আবান ইবনে উসমান রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন ৷ আমি আমার পিতার জবানের শুনেছি যে , রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় ৩ বার করে উক্ত দুুআ পাঠ করবে কেউ বা কিছুই তার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা ৷
( জামে তিরমিযী: হাদীস নং ৩৩৮৮,আবু দাউদ:হাদীস নং ৫০৮৮)
তৃতীয় আমল :
তদবির কারী নিজের স্ত্রী ,পরিজনদের হেফাজতে রাখতে বাড়ি বন্ধ করে রাখতে পারেন । এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান একটি বিষয় । ( বাড়ি বন্ধের আলাদা কনটেন্ট প্রয়োজন হলে কমেন্ট করুন । )
রুকইয়ার তিন স্তর :
রুকইয়াহ শরইয়্যার ক্ষেত্রে যা কিছু পাঠ করা হয় সেগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় ।
১. সর্বোত্তম
২. উত্তম
৩. বৈধ
সংক্ষেপে এগুলোর পরিচয় উল্লেখ করছি।
১. সর্বোত্তম রুকইয়া
(ক)রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, জিব্রাইল আলাইহিস সালাম অথবা সাহাবায়ে কেরাম যেসব দোয়া এবং আয়াত দ্বারা রুকইয়া করেছেন ।
যেমন সূরা ফাতিহা, সূরা ফালাক, সূরা নাস প্রভৃতি ।
(খ) যেসব আয়াত এবং দোয়া শয়তান থেকে নিরাপদ থাকতে, বিপদ থেকে বাঁচতে কিংবা সুস্থতার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পড়েছেন অথবা কাউকে পড়তে বলেছেন । যেমন সম্পূর্ণ সূরা বাকারা, আয়াতুল কুরসি ,সকাল সন্ধ্যার মাসনুন দোয়া সমূহ ।
(গ) পবিত্র কুরআনুল কারীমে অথবা বিশুদ্ধ সূত্রে হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন নবীগণের দোয়া ।
২. উত্তম
পবিত্র কুরআনুল কারীমের যে সকল আয়াত আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্যার সমাধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল । মাসনুন রুকইয়ার পর তুলনামূলকভাবে এ সকল আয়াত অন্যান্য আয়াতের চেয়ে অধিক উপকারী । উদাহরণস্বরূপ:
যে আয়াতে টোনার কথা আছে সেটা টোনা গ্রস্থ ব্যক্তির জন্য । যে আয়াতের জিন বা শয়তানের কথা আছে সেটা জিনের রোগীদের জন্য অধিক উপকারী ।
টোনাগ্রস্থ ব্যক্তি জন্য সূরা আরাফের ১১৭ আয়াত থেকে ১২২ নং আয়াত। সূরা ইউনুসের ৮১ থেকে ৮২ নং আয়াত, সূরা ত্বহার ৬৯ নং আয়াত ।
জিন আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সূরা বাকারার ১০২ নং আয়াত , সূরা সাফফাতের ১ থেকে ১০ নং আয়াত এবং সূরা জীনের ১ থেকে ৯ নং আয়াত ।
বদ নজরের জন্য সূরা ইউসুফের ৬৭ নং আয়াত ,সূরা কাহাফের ২৯ নং আয়াত এবং সূরা কালামের শেষ ২ আয়াত।
৩. বৈধ রুকইয়া
এছাড়া আপনারা কুরআনুল কারীমের অন্য যে কোন আয়াত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে কোন দোয়া দিয়ে রুকইয়া করতে পারেন ।
আরবি কিংবা নিজস্ব ভাষাতে ও দোয়া করতে পারবেন । প্রসিদ্ধ দুটি দোয়া দেখুন ।
اللهم ابطل كل سحر اينما كانت وكيفما كانت
অনুবাদ: হে আল্লাহ সব যাদু-টোনা ধ্বংস করে দাও । তা যেখানেই থাকো এবং যেভাবেই থাকুক ।
اللهم انزل الشفاء وارفع كل الداء
অনুবাদ: হে আল্লাহ সুস্থতা অবতীর্ণ করো এবং সব রোগ ব্যাধি তুলে নাও ।
রুকইয়ার সাপ্লিমেন্টারি :
এখানে কিছু ঔষধি গুণসম্পন্ন জিনিসের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করে দেওয়া হবে । এগুলো রুকইয়া নয় বরং রুকইয়ার সম্পূরক বা কার্যকারিতা বর্ধক বস্তু । এগুলো হাতের কাছে পাওয়া গেলে এবং ব্যবহার সম্পর্কে আপনাদের যথেষ্ট ধারণা থাকলে তখন ব্যবহার করতে পারেন। আর এগুলো না পেলে বিকল্প হিসেবে অন্য কিছু ব্যবহার করবেন ।
১. রুকইয়ার পানি
সবচেয়ে উত্তম হলো জমজমের পানি । জমজমের পানিতে শিফা রয়েছে। তাই এর ওপর রুকইয়ার আয়াত পড়া হলে তার উপকারিতা বেড়ে যায় আরো বহুগুণ । আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ,পৃথিবীর বুকে সর্বোত্তম পানি হচ্ছে জমজমের পানি । যাতে রয়েছে ক্ষুধার্তদের জন্য খাদ্য এবং অসুস্থতার জন্য আরোগ্য ।
( আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নং ৮১২৫)
জমজমের পর উত্তম পানি হচ্ছে বৃষ্টির পানি । হযরত আনাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন ,একবার আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর সাথে ছিলাম । তখন বৃষ্টি নামলো । রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাপড় প্রসারিত করলেন । যাতে সেটা পানি স্পর্শ করে । আমরা বললাম ,আপনি কেন এমন করলেন? তিনি বললেন ,কারণ এটা তার মহান রবের নিকট থেকে এখনই এসেছে ।
(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৯৮ )
বি:দ্র: জমজম এবং বৃষ্টির পানি না পাওয়া গেলে সাধারন পানি দিয়েও রুকইয়া করা যাবে । রুকইয়ার পানি সাধারণত পান করার জন্য এবং গোসল ব্যবহার করা হয় কিংবা রোগীর ওপর ছিটিয়ে দেওয়া হয় । তাই তার সাথে অন্য পানির মিশ্রণ ঘটালে কোন সমস্যা নেই ।
২. হিজামা বা সিঙ্গা
রুকইয়ার পাশাপাশি হিজামা করানোর উপকারিতা অতুলনীয় । বিশেষত জাদু বা বদনজর আক্রান্ত হওয়ার কারণে যদি অসুস্থ হয়, কিংবা অন্যান্য শারীরিক সমস্যা থাকে, তাহলে রুকইয়ার সাথে হিজামা খুবই ফলপ্রসূ । বর্তমানে হিজামা কাপের মাধ্যমেও করানো হয় । এটাকে বলে কাপিং থেরাপি ।
হিজামা সম্পর্কিত একাধিক হাদীস রয়েছে। এখানে একটি উল্লেখ করা হচ্ছে । ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মিরাজের রাতে আমি ফেরেশতাদের যে দলকে অতিক্রম করেছি, তাদের সকলে আমাকে বলেছেন, হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ,আপনি অবশ্যই হিজামা করবেন ।( সুনানে ইবনে মাজাহ , হাদীস নং ৩৪৭৬)
৩ মধু
মধু সাধারণত খাওয়ার জন্য আনা হয়। কালোজিরা আর মধু একত্রে খাওয়া প্রসিদ্ধ রীতি । তবে সুন্নাত হচ্ছে পান করা অর্থাৎ পানিতে গুলিয়ে সেটা পান করা । এছাড়া বিভিন্ন ওষুধের সাথে মধু ব্যবহার করা হয় । প্রথমত রুকইয়া করার ক্ষেত্রে মধু খাওয়ানো হলে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে । তবে নিয়ম তান্ত্রিক চালিয়ে গেলে এক সময় আল্লাহর ইচ্ছায় আরোগ্য লাভ হবে । মধু সম্পর্কে একাধিক আয়াত ও হাদীস রয়েছে । এখানে শুধু একটি উল্লেখ করা হচ্ছে ।
হযরত আবু সাঈদ রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বলল ,আমার ভাইয়ের পেটে অসুখ হয়েছে । তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে মধু পান করাও । এরপর দ্বিতীয়বার লোকটি এলে তিনি বললেন তাকে মধু পান করাও । সে তৃতীয়বার এলে তিনি বললেন তাকে মধু পান করাও । এরপর লোকটি পুনরায় এসে বলল আমি অনুরূপ করেছি । ( অন্য বর্ণনায় আছে আমি অনুরুপেই করেছি ,কিন্তু সমস্যা তো বেড়ে যাচ্ছে ) তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ,আল্লাহ সত্য বলেছেন আর তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা বলছে ।
তাকে মধু পান করাও । সে তাকে আবার মধু পান করালো ।তখন সে আরোগ্য লাভ করল । ( সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৩৬০)
৪. কালোজিরা
রুকইয়ার পাশাপাশি কালোজিরা সাধারণত মধুর সাথে খাওয়া হয় । শুধু কালোজিরা চিবিয়ে বা পিষে খাওয়া হয় । এ ছাড়া কালোজিরা তেল মাথায় এবং শরীরের ব্যবহার করা হয় । কালোজিরার উপকারিতা সম্পর্কে চিকিৎসা শাস্ত্রে অনেক তথ্য-উপাত্ত রয়েছে । হাদীসেও এসেছে । আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ,তোমরা নিজেদের জন্য এই কালোজিরার ব্যবহারকে আবশ্যক করে নাও । কেননা মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের নিরাময় রয়েছে এর মধ্যে ।
( জামে তিরমিজি, হাদীস নং ২০৪১)
৫. খেজুর
জাদুর রুকইয়া করার পরে আজওয়া খেজুর খেতে পরামর্শ দেওয়া হয় । অনেক ক্ষেত্রে রাক্কীও অনেক সময় নিজের কাছে আজওয়া খেজুর রাখেন এবং রোগীকে খেতে বলেন । রোগী ছাড়াও সবাই খেজুর সব সময় খেতে পারে । এটি উৎকৃষ্ট একটি খাদ্য । খেজুর সম্পর্কিত একাধিক হাদীসের ভান্ডার থেকে দুটি উল্লেখ করা হচ্ছে ।
সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সকাল বেলায় সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে । সেদিন তাকে কোনো বিষ বা জাদুকর ক্ষতি করবে না । ( সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৪৩৬)
হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ,মদিনার উঁচু ভূমির অঞ্চলের আজওয়া খেজুরে আরোগ্য রয়েছে । অথবা প্রতিদিন সকালে এর আহার বিষ নাশক ( হিসেবে কাজ করে ।)( সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৮১৫)
৬. সদকা করা ও দোয়া করা
রুকইয়া করাবস্থায় রোগ থেকে মুক্তির জন্য কিছু দান সদকা করা সুস্থতাকে ত্বরান্বিত করবে ইনশাআল্লাহ । আর দোয়া তো অবশ্যই করতে হবে । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন যাদু আক্রান্ত হয়েছিলেন তখন কয়েকদিন দোয়া করেছিলেন । এরপরে আল্লাহ তা’আলা তার চিকিৎসার জন্য সূরা ফালাক এবং সূরা নাস নাযিল করেছেন ।
তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি দোয়া করা । প্রত্যেকটি সমস্যার কথা বারবার বলা । সুস্থ থাকার প্রার্থনা করা । এবং বিপদ থেকে মুক্তি চাওয়া । এর সম্পর্কে একটি হাদীস উল্লেখ করা হচ্ছে ।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের সম্পদ হেফাজত করো জাকাত প্রদানের মাধ্যমে, তোমাদের রোগের চিকিৎসা করো সদকার মাধ্যমে, আর তোমাদের বিপদ দূর করো দোয়ার মাধ্যমে । ( আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নং ২০০৬)
৭. তাহাজ্জুদ নামাজ
তাহাজ্ সুস্থতা লাভের উসিলা এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার একটি চমৎকার সুযোগ । এজন্য রুকইয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন রাতে অল্প কয়েক রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সুস্থতা এবং বিপদ থেকে মুক্তি চাওয়া অনেক ফলদায়ক। হযরত বেলাল রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তাহাজ্জুদ পড়াকে আবশ্যক করে নাও । কারণ এটা তোমাদের সালাফে সালেহীনদের অনুসৃত রীতি । রাতের নামাজ তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। গোনাহ থেকে বারণকারী, পাপ মোচনকারী এবং শরীর থেকে রোগ ব্যাধি দূরকারী ।( জামে তিরমিজি, হাদীস নং ৩৫৪৯)
৮. তাওবা- ইস্তেগফার
বেশি বেশি ইস্তেগফার করলে আয় রোজগার ,বিয়ে অথবা সন্তান-সন্ততি বিষয়ক বিপদ, ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি থেকে আল্লাহ তায়ালা সহজে মুক্তি দেন । যদি কোন পাপের কারণে বিপদ এসে থাকে তবে তাওবার কোন বিকল্প নেই । বিপদের সময় প্রচুর পরিমাণে ইস্তেগফার করা উচিত । রুকইয়া চলা কালীন সময়ে ও ইস্তেগফার অধিক পরিমাণে পড়া উচিত ।
রুকইয়ার আয়াত সমূহের নাম:
বিভিন্ন রোগের জন্য বিভিন্ন আয়াতের রুকইয়া আছে । এখানে রুকইয়ার সাধারণ আয়াত সমূহের নামের তালিকা দেওয়া হলো । নিজেরাই আয়াত গুলো বের করে আমল করতে পারেন। বের করতে সম্ভব না হলে কমেন্ট করুন । আলাদা কন্টেন্ট লিখে দেয়া হবে ইনশাল্লাহ ।
১ . সূরা ফাতিহা
২. সূরা বাকারাহ ১–৫
৩. সূরা বাকারাহ ১০২
৪. সূরা বাকারাহ ১৬৩–১৬৪
৫. সূরা বাকারাহ ২৫৫
৬. সূরা বাকারাহ ২৮৫–২৮৬
৭. সূরা আল ইমরান ১৮–১৯
৮.সূরা আরাফ ৫৪–৫৬
৯.সূরা আরাফ ১১৭ –১২২
১০. সূরা ইউনুস ৮১–৮২
১১. সূরা ত্বহা ৬৯
১২. সূরা মুমিনুন ১১৫–১১৮
১৩. সূরা সাফফাত ১–১০
১৪. সূরা আহকাফ ২৯–৩২
১৫. সূরা আর রাহমান ৩৩–৩৬
১৬. সুরা হাশর ২১–২৪
১৭. সূরা জীন ১–৯
১৮. সূরা ইখলাস
১৯. সূরা ফালাক
২০ সূরা নাস
রুকইয়ার করার নিয়ম :
রুকইয়া বিভিন্ন রোগের হতে পারে । যেমন:
জাদুর রুকইয়া,বিয়ে হওয়ার রুকইয়া, আসক্ত বা বশ করার রুকইয়া, পাগল ভালো করার রুকইয়া, অসুস্থ থেকে সুস্থ হওয়ার রুকইয়া,অনিয়মিত স্রাবের সমস্যার রুকইয়া, সহবাসে সক্ষম করার রুকইয়া,গর্ভে সন্তান আসার জন্য রুকইয়া ইত্যাদি ।
উল্লেখিত এসব রোগ ছাড়া আরো যত রোগ রয়েছে সবগুলোর রুকইয়া করার নিয়ম আছে । তবে ঐ সমস্ত বিষয় এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয় । এগুলোর প্রত্যেক টি এতো লম্বা আলোচনা যে প্রত্যেকটা আলাদা কনটেন্ট লেখার দাবি রাখে।
নিজের রুকইয়া করার নিয়ম:
কার কি রকম রোগ আছে সেটা এখন জানা নেই । আপনাদের বোঝানোর জন্য এখানে জাদু-টোনা সমস্যায় নিজে নিজের রুকইয়া করার নিয়ম লিখে দেওয়া হচ্ছে । এটি উদাহরণস্বরূপ হলেও কাজে লাগবে ইনশাআল্লাহ।
জাদু-টোনা সমস্যার জন্য নিজে নিজে রুকইয়া করতে চাইলে প্রথমে মানসিক প্রস্তুতি নিবেন । পাক্কা ইরাদা করে নিবেন । সমস্যার একটা বিহিত করে তবেই ক্ষান্ত হবেন । নিজে নিজে রুকইয়া শুরু করে কয়েকদিন যেতে না যেতে অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । অনেকে একটু উন্নতি দেখলেই আমল করা বন্ধ করে দেয় । এমন করা যাবে না । রুকইয়া চলাকালীন রোগীর জরুরি বিষয়গুলো খেয়াল রাখা আর মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার মতো কেউ সাথে থাকলে অনেক ভালো হয় ।
প্রথমে ভালোভাবে পাক পবিত্র হয়ে দুই রাকাত সালাত পড়ুন । সবচেয়ে উত্তম হলো তাহাজ্জুদের সময় ।নইলে অন্য যে কোন জায়েজ ওয়াক্তে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ুন । এরপর দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে আপনার সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য এবং রোগ থেকে আরোগ্য জন্য দোয়া ইস্তেগফার এবং দুরুদ শরীফ পড়ে চিকিৎসা শুরু করুন ।
হাতের কাছে এক বোতল বা জগে পানি নিয়ে বসুন । প্রথমে কয়েকবার পূর্বে উল্লেখিত রুকইয়ার আয়াত গুলো তেলাওয়াত করুন । তারপরে পানিতে ফুঁক দিয়ে কিছুটা খেয়ে নিন ।
এরপর সূরা ফাতিহা ,আয়াতুল কুরসি ,সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস এই সবগুলো তিনবার করে পড়ুন । তার সঙ্গে নিম্নের আয়াতগুলো পড়ে পানিতে ফু দিন ।
وَاَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰی مُوۡسٰۤی اَنۡ اَلۡقِ عَصَاکَ ۚ فَاِذَا ہِیَ تَلۡقَفُ مَا یَاۡفِکُوۡنَ ۚ .فَوَقَعَ الۡحَقُّ وَبَطَلَ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ۚ .فَغُلِبُوۡا ہُنَالِکَ وَانۡقَلَبُوۡا صٰغِرِیۡنَ ۚ .وَاُلۡقِیَ السَّحَرَۃُ سٰجِدِیۡنَ ۚۖ .قَالُوۡۤا اٰمَنَّا بِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ۙ .رَبِّ مُوۡسٰی وَہٰرُوۡنَ.
(আল আরাফ ১১৭– ১২২)
فَلَمَّاۤ اَلۡقَوۡا قَالَ مُوۡسٰی مَا جِئۡتُمۡ بِہِ ۙ السِّحۡرُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ سَیُبۡطِلُہٗ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یُصۡلِحُ عَمَلَ الۡمُفۡسِدِیۡنَ .وَیُحِقُّ اللّٰہُ الۡحَقَّ بِکَلِمٰتِہٖ وَلَوۡ کَرِہَ الۡمُجۡرِمُوۡنَ ٪
(সুরা ইউনুস ৮১–৮২ )
وَاَلۡقِ مَا فِیۡ یَمِیۡنِکَ تَلۡقَفۡ مَا صَنَعُوۡا ؕ اِنَّمَا صَنَعُوۡا کَیۡدُ سٰحِرٍ ؕ وَلَا یُفۡلِحُ السَّاحِرُ حَیۡثُ اَتٰی .
( সূরা ত্বহা ৬৯ )
নিজে নিজে রুকাইয়া করার নিয়ম
এরপরে আপনাদের করণীয় হলো–
১. এই পানি প্রতিদিন দুই অথবা তিন বেলা আধা ক্লাস করে খাবেন।
২. আর প্রতিদিন গোসলের পানির সাথে এই পানি কিছুটা মিশিয়ে গোসল করবেন ।
৩. প্রতিদিন একনাগরে কমপক্ষে ৪৫ মিনিট রুকাইয়া নিয়তে কোরআন তেলাওয়াত করবেন ।
৪. মুভি মিউজিক এবং শরীয়তে নিষিদ্ধ এমন সবকিছু থেকে দূরে থাকবেন । মেয়ে হলে শরীয়তের বিধান পর্দা অনুযায়ী চলবেন ।
৫. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ঠিকমতো আদায় করবেন । কোন ওয়াজিব কিংবা ফরজ এবাদত যেন ছুটে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন ।
৬. শয়তান থেকে বাঁচতে সকাল সন্ধ্যা এবং ঘুমের আগের মাসনুন আমল গুলো গুরুত্বের সাথে পালন করবেন । অন্তত সূরা এখলাস ,সূরা ফালাক, সূরা নাসের আমল যেন কখনো বাদ না যায় ।
৭. এই দোয়াটি প্রতিদিন সকালে ১০০ বার এবং সন্ধ্যায় একশতবার পড়বেন । এতগুলো পড়া সম্ভব না হলে কমপক্ষে সকালে দশ বার আর সন্ধ্যায় দশবার পড়বেন । দোয়াটি হল- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদ ,ওহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কদীর।
৮. ঘুমের আগে সূরা এখলাস ,সূরা ফালাক, সূরা নাস পড়ে দুই হাতে ফু দিয়ে পুরো শরীরে হাত বুলিয়ে নিবেন । এভাবে তিনবার করবেন আর আয়াতুল কুরসি পরে ঘুমাবেন ।
৯. অজু গোসলসহ পাক না পাকের ব্যাপারে সচেতনতা অবলম্বন করবেন । বিশেষ করে ফরজ গোসলের ব্যাপারে ।প্রয়োজন হলে এ সম্পর্কে মাসয়ালা -মাসায়েল জেনে নিবেন ।
১০. বেশি বেশি ইস্তেগফার ও দরুদ শরীফ পাঠ করবেন । তাহাজ্জুদ আর নফল নামাজ পড়ে আপনার সমস্যা এবং পেরশানী থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বেশি বেশি দোয়া করবেন ।
শেষকথা
প্রিয় পাঠক । রুকাইয়া করার নিয়ম নিয়ে এতক্ষণ বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আশা করি বিষয়টি ক্লিয়ার হয়েছে । এরপরও যদি রুকাইয়া নিয়ে আপনাদের মাঝে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে জানাতে পারেন। চেষ্টা করবো আপনাদের সমস্যার সমাধান দেবার । ইনশাআল্লাহ ।
গ্রন্থনা: মাওলানা শরিফ আহমাদ
শিক্ষক ও লেখক